দমনমূলক শাসনব্যবস্থা কিংবা মহামারি করোনা ভাইরাস কোনো কিছুই নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের নিরাপদে, সম্মানের সঙ্গে স্বদেশে ফেরার অধিকারকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না বলে মন্তব্য করেছেন রোহিঙ্গা নেতারা।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট উত্তর রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ নৃশংসতা চালায় মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। মঙ্গলবার নির্মম সেই ঘটনার তৃতীয় বর্ষপূর্তি। তিন বছর পরও নিজের নাগরিক অধিকার ফিরে পাওয়ার দাবিতে অটল বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর শরণার্থী শিবির থেকে একজন রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন বাকি থাকলেও প্রবাসী রোহিঙ্গাদের লড়াইয়ের সমাপ্তি হবে না। আনাদোলু এজেন্সিকে বলেন, বার্মিজ রোহিঙ্গা অ্যাসোসিয়েশনের (বিআরএএনএ) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ডা. ওয়াকার উদ্দীন।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চালানো জাতিনিধনের হাত থেকে বাঁচতে নির্যাতনের শিকার হয়ে সাড়ে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসান পদক্ষেপ জরুরি ভিত্তিতে এগিয়ে নেয়া উচিৎ, বলেন ওয়াকার। তিনি আরাকান রোহিঙ্গা ইউনিয়নের (এআরইউ) মহাসচিবেরও দায়িত্ব পালন করছেন।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২৪ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করেছে মিয়ানমার রাষ্ট্রীয় বাহিনী। আন্তারিও ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলভমেন্ট এজেন্সির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
৩৪ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছে। ব্যাপকভাবে প্রহার করা হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার জনকে। ফোর্সড মাইগ্রেশন অব রোহিঙ্গা: দি আনটোল্ড এক্সপেরিয়েন্স শিরোনামের প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়।
‘রাষ্ট্রীয়ভাবে বর্জন এবং বহিষ্কার বন্ধ হওয়া জরুরি’
লন্ডনভিত্তিক স্কলার-সমাজকর্মী মুয়াং জারনি আনাদোলু এজেন্সিকে বলেন, ১৯৮২ সালে নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে মিয়ানমারের স্বৈরশাসক নে উন রোহিঙ্গাদের বর্জন-বহিষ্কার এবং তাদের জাতিসত্তাকে ধ্বংসের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
‘এটি একটি বর্ণবাদী আইন। রোহিঙ্গারা এ আইনের অবসান চান, বলেন জারনি।
রোহিঙ্গাদের অধিকারের পক্ষের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত জারনি বলেন, ১৯৮২ সালের মিয়ানমারে নাগরিকত্বের আইনের মূল বিষয়টি সম্পর্কে আমি জানি। আইনটি করাই হয়েছিল রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা এবং নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার জন্য।
তিনি বলেন, শরণার্থীরা উত্তর রাখাইনে ফিরতে চায়। তারা সেখানে অন্য জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করতে চায়। তারা রাখাইনের ভাই-বোন হিসেবে অন্য জাতিসত্ত্বার মানুষের সঙ্গে সম্প্রীতি গড়ে তুলতে চায়।
ওয়াকার বলেন, মিয়ানমার-বাংলাদেশ সই হওয়া প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী বাস্তুচ্যুতের নিরাপদে, সম্মানের সঙ্গে, স্বেচ্ছায় নিজ বাড়ি আরাকানে ফেরার ব্যবস্থা করতে নেইপিদোর উপর আন্তর্জাতিক চাপ তৈরিতে সব ধরনের সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে প্রবাসী রোহিঙ্গারা।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট চালানো নৃশংসতা থেকে প্রাণ বাঁচাতে সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। যাদের অধিকাংশ নারী ও শিশু। বর্তমানে বাংলাদেশে ১২ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বলেও জানানো হয়।
১৮ হাজারের মতো রোহিঙ্গা নারী ও শিশু মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং পুলিশের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ১ লাখ ১৫ হাজার বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ঘরবাড়ি।
‘সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে’
শরণার্থী মানাবধিকারকর্মী ইমরান মুহাম্মদ বলেন, শরণার্থী সংকট তৈরি করেছে মিয়ানমার সরকার। অবশ্যই সংকট সমাধানের উপায়ও তাদের হাতে। মিয়ানমারকে অবশ্যই নাগরিকত্ব দিয়ে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের বিনাশর্তে দেশে ফেরার সুযোগ দিতে হবে। মালয়েশিয়া থেকে আনাদোলু এজেন্সিকে জানান ইমরান। ২০১৭ সাল থেকে তিনি সেখানে বসবাস করছেন।
রোহিঙ্গা সংকট কী আসলে কখনো শেষ হবে না? ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে রোহিঙ্গারা বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে। আমিও শরণার্থী শিবিরে জন্মেছি। বড় হয়েছি। আমরা জানি না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আমারা আর কি চাইতে পারি, বলেন ইমরান।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিৎ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সমন্বিতভাবে চাপ তৈরি করা। অথবা রোহিঙ্গা সংকটের বিকল্প সমাধান বের করা।
বিকল্প উপায়ের বিষয়ে ইমরানের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন আয়ারল্যান্ড প্রবাসী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্য মোহাম্মদ রাফিক। বলেন, রোহিঙ্গারা তাদের বাপদাদার ভিটায় ফিরবে। এটাই একমাত্র সমাধান। যেখানে তাদের পূর্বপুরুষেরা সমতা এবং আত্মপরিচয় নিয়ে বসবাস করেছেন। সেখানেই আমাদের নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠবে।
ইউরোপীয় রোহিঙ্গা কাউন্সিলের সচিব রফিক বলেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে জবাবদিহিতার আওতার আনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা নির্যাতনের অবসান করতে চাই আমরা।
‘মিয়ানমারকে আইসিজে-তে নেয়া ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’
যুক্তরাষ্ট্রের পেনসেলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ওয়াকার বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার মামলা ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা এর আগে বিশ্বের কোনো মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য এমন আইনি পদক্ষেপ নেয়নি।
আইসিজে’র ২৩ জানুয়ারির নির্দেশনায় বলা হয়, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মানসিক ও শারীরিক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষায় সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য থাকবে মিয়ানমার।
ওয়াকার বলেন, আইসিজে সাধারণত বিভিন্ন দেশের মধ্যে জলসীমা বা স্থলসীমান্ত বিতর্ক নিয়ে শুনানি করে থাকে। কিন্তু রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। ন্যায় বিচার নিশ্চিতে বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ একটি নজির স্থাপন করেছে।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের সরকার এবং দেশটির সামরিক জান্তার উপর প্রভাব বিস্তারকারী দেশগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান জারনি। বলেন, বিদেশি সরকারগুলেরা উচিৎ রোহিঙ্গাদের সহায়তা করা। তাদের নিজ বাড়িতে ফেরার দাবিকে সমর্থন করা। যাতে তারা নিজভূমে ফিরতে পারে। বিষয়টি সহজ নয়। কিন্তু অসম্ভবও নয়।
‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘের ভূমিকা’
রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্বীকার করেছেন ওয়াকার। তবে নিরাপত্তা পরিষদের অবস্থান দুঃখজনক বলে জানান তিনি।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে স্মরণীয় পদক্ষেপ নিয়েছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অসংখ্য প্রস্তাব পাস হয়েছে। গেলো কয়েক বছরে বহু প্রস্তাব পাস করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা। নিরাপত্তা পরিষদও বিষয়টি বিতর্কের জন্য উত্থাপন করেছে। যদিও চীন, রাশিয়া কোনো প্রস্তাব পাস করতে দেয়নি। জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদন আইসিজেতে ব্যাপকভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে, বলেন ওয়াকার।
বিচারের দাবি অব্যাহত থাকবে। চূড়ান্তভাবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব এবং তাদের দেশে ফেরার সুযোগ তৈরিতে আমাদের লড়াই চলবে। শুধুমাত্র সংখ্যালঘু এবং ইসলাম ধর্মের অনুসারী হওয়ায় রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার এবং তাদের দেশছাড়া করেছে মিয়ানমার।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ত্রিমুখী তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে মুসলমানদের সবচেয়ে বড়জোট ওআইসি। রাজনৈতিক তৎরপতা, মানবিক সহায়তা প্রদান একইসঙ্গে আইনি পদক্ষেপে সহায়তা করেছে জোট।
ওয়াকার বলেন, রাজনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমনকি চীন, রাশিয়াসহ বিশ্ব শক্তিগুলোকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। মিয়ানমারের আরাকানে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতদের মানবিক সহায়তা দিচ্ছে ওআইসিসহ বিভিন্ন দেশ। এ সহায়তা অব্যাহত রয়েছে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্যও।
‘মূল্যবান সময় নষ্ট’
আরাকান রোহিঙ্গা ইউনিয়নের প্রধান, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনাতে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ায় অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন ওয়াকার। তিন বছর ধরে বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরে রোহিঙ্গা বসবাস করছে। শরণার্থী শিবিরে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা না থাকায় তাদের দুর্ভোগ দিনদিন বাড়ছে। অস্থায়ী এসব কেন্দ্রে বছরের পর বছর তারা থাকতে পারে না।
রোহিঙ্গা শিশুরা নিজের জন্মভূমি ছাড়া বড় হচ্ছে। তারা পর্যাপ্ত শিক্ষা পাচ্ছে না। সঠিক স্বাস্থ্য সেবা নেই। এরক আরো নানা অনিশ্চয়তা রয়েছে। যেগুলো তাদের ভবিষতকে হুমকিতে ফেলছে। বলেন ওয়াকার।
তিনি বলেন, নতুন শিশু জন্মানোর কারণে শরণার্থী শিবিরের জনসংখ্যা প্রতিদিনই উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কারণে আমাদের জাতিগত একতা হুমকিতে পড়েছে।
তবে আমরা আত্মবিশ্বাসী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অভূতপূর্ণ প্রচেষ্টায় সংকট সমাধানের একটি পথ নিশ্চয় বেরোবে। রোহিঙ্গারা আরাকানে ফেরার পর তাদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক উন্নয়নে জাতিসংঘের সংস্থাগুলো যথাযথ ব্যবস্থা নেবে, বলেন ওয়াকার।
দমনমূলক শাসন ব্যবস্থা বা করোনা মহামারী কোনো কিছুই রোহিঙ্গাদের উপর যারা নির্যাতন চালিয়েছে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা, নাগরিকত্বের অধিকার পুনর্বহাল এবং নিজ দেশে ফিরতে চাওয়ার দাবিকে থামিয়ে রাখতে পারবে না। বলেন, যুক্তরাজ্য ভিত্তিক ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা রো নায়ে সান লিউন।
সূত্র: আনাদোলু এজেন্সি। ভাষান্তর: ফাইয়াজ আহমেদ